প্রজাপতির অবাক করা ব্যাপারস্যাপারএই ক্ষুদে প্রাণীটারও আছে বিচিত্র আচরণ আর মজার কিছু ব্যাপারস্যাপার। কী সেই ব্যাপারস্যাপার? জানাচ্ছেন জুবায়ের হোসেনকোকিল না জানিয়ে ডিম পেড়ে যায় কাকের বাসায়। এদিক থেকে প্রজাপতি মহাশয় আবার বেজায় ভদ্র! পারতপক্ষে নিজের এলাকার কয়েকটি নির্দিষ্ট গাছ ছাড়া এরা ডিম পাড়ে না। আবার কিছু প্রজাপতি একটা নির্দিষ্ট ধরনের গাছ ছাড়া অন্য কোনো গাছে ডিম পাড়ে না। গাছের পাতায় ডিমগুলো আঠার মতো লেগে থাকে। কয়েক সপ্তাহ পর তা থেকে জন্ম নেয় প্রজাপতির লার্ভা অর্থাৎ শুঁয়ো পোকা। এই শুঁয়ো পোকা জন্মের পর থেকে দিন-রাত খাবার খুঁজে আর খেয়েই কাটিয়ে দেয়। খাইদাই ছাড়া আর কোনো কাজ নেই!
গাছগুলোই বা কম কিসে? প্রজাপতিকে তাদের পাতায় ডিম পাড়তে দেবে না। শুঁয়ো পোকা বের হয়ে শেষকালে সব পাতা খেয়ে সাবাড় করে দেবে, সে জন্য এক ধরনের আঙুর গাছের পাতা তাদের পিঠে একসঙ্গে বেশি ডিম পাড়ার জায়গা দিতে চায় না। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি ডিম হলে পাতার ওই অংশটা শুকিয়ে গিয়ে ডিমসহ মাটিতে পড়ে যায়। নিজের নাক কেটে হলেও পরের যাত্রা ভঙ্গ করা ছাড়া আর কী?
অন্য এক ধরনের আঙুর গাছ তো এক কাঠি সরেস। ডিমের মতো দেখতে ছোট ছোট গোলাকার বস্তু দিয়ে নিজেরাই পাতাটা ঢেকে রাখে, যাতে কোনো প্রজাপতি এসে মনে করে আগেই কেউ ডিম পেড়ে রেখে গেছে। কী অদ্ভুত_তাই না!
শুঁয়ো পোকা থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতিতে পরিণত হওয়ার মাঝের ধাপটি হলো পিউপা। এ পর্যায়ে এসে এরা খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে পাতার নিচে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে। পিউপা অবস্থায় টিকে থাকার জন্য কখনো কখনো মিত্রপক্ষ পিঁপড়ার সাহায্য নেয়। পিঁপড়া এদের অন্য পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে, আর বিনিময়ে পিউপা এক ধরনের চিনির মতো মিষ্টি রস তৈরি করে, যা পিঁপড়ার প্রিয় খাদ্য। এ অবস্থা থেকে প্রজাপতিতে পরিণত হলেই সুন্দর পাখা গজায় ও মাথার কাছে থাকে দুটি শুঁড়। এগুলোর নাম অ্যান্টেনা, যেটি কাজে লাগায় স্পর্শ করতে বা স্বাদ-গন্ধ নেওয়ার জন্য।
প্রজাপতির পাখা কিন্তু আসলে স্বচ্ছ। তাহলে এত রং দেখ কিভাবে? পাখার ওপরটা সূক্ষ্ম স্কেল দিয়ে ঢাকা থাকে। স্কেলের রঙেই দেখা যায় প্রজাপতির হরেক রং। আবার কখনো তাতে আলো প্রতিফলিত হয়েও বহু রং ধরা দেয়। আলতো করে পাখা ধরলে প্রজাপতির কোনো ক্ষতি নেই। তবে মাথায় আঘাত পেলে সেখানেই দফারফা।
সুন্দর এ প্রাণীটির প্রতি কমবেশি সবাই আকৃষ্ট হয়, তাই নিজেকে রক্ষার জন্য একটু চালাকির আশ্রয় নেয়। প্রজাতিভেদে কারো কারো বিষও থাকে। তবে সবার তো আর সেটি নেই। তাই নিজেকে লুকিয়ে রাখার জন্য অদ্ভুত সব উপায় বের করে। নিরীহ প্রজাপতি কখনো রং-ঢং বদলে অবিকল বিষওয়ালা প্রজাপতির রূপ নেয়। তখন পারতপক্ষে তাকে আর ঘাঁটাতে আসে না শত্রুপক্ষ। একে বলে মিমিক্রি করা; ঠিক যেমন পাকা অভিনেতা চাইলে অন্যকে নকল করতে পারেন। যে বিজ্ঞানী প্রজাপতিসহ আরো কিছু প্রাণীর মধ্যে এটি প্রথম পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, তাঁর নামানুসারে এর নাম দেওয়া হয়েছে 'বাটেসিয়ান মিমিক্রি'।
ডোরাকাটা ডানার এক ধরনের প্রজাপতি বসে থাকলে কোনটা সামনের দিক আর কোনটা পেছনের দিক_ঠিকমতো ঠাওর করা যায় না। বোকা বানানোর জন্য সামনের অ্যান্টেনার পেছনের দিকে ছোট লেজ থাকে। পাখি ভুল করে পেছন থেকে খেতে আসে। ততক্ষণে সে মাথা বাঁচিয়ে পগারপার। পিকক প্রজাপতির ডানায় বড় বড় চোখের মতো নকশা থাকে। খেতে এসে এত চোখ দেখে আক্রমণকারী বাপ বাপ বলে পালায়। দক্ষিণ আমেরিকার এক ধরনের প্রজাপতি নিতান্ত ভালো মানুষটির মতো গাছের কাণ্ডে বসে থাকে। যেই না কেউ ধরতে গেল, অমনি ঘুরে উল্টোপাশে চলে যায়। মানুষটা ঘুরে ওপাশে যেতে যেতে সে আবার এপাশে চলে আসে। যতক্ষণ না মানুষটা ক্লান্ত হচ্ছে ততক্ষণই চলতে থাকে লুকোচুরি খেলা।
এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, প্রজাপতি কি বুদ্ধিমান? তা বুদ্ধির কিছু প্রমাণ তো এরা রাখেই। এমনিতে সারা দিন একা একা ঘুরে বেড়ালেও বিশ্রামের সময়টায় সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়। যেখানে সব সময় বিশ্রাম নেয়, সেই জায়গাটা ভালোই মনে থাকে। সবাই একসঙ্গে বসে বিশ্রামের আরেকটা কারণও আছে। যদি কোনো পাখি একটাকে ধরে খেয়েও ফেলে তবে বিস্বাদ মনে হলে অন্যদের হয়তো ছুঁয়েও দেখবে না। এভাবে বেঁচে যেতে পারে অন্যরা।
সেই অর্থে প্রজাপতির কান না থাকলেও ডানার নিচে 'কানসদৃশ' পর্দা দেখা যায়. যেটা উচ্চ কম্পাঙ্কের শব্দ আলাদা করে চিনতে পারে। সব প্রজাতির কিন্তু আবার তা থাকে না। তবে সবারই ছয়টি করে পা থাকে। সামনের পা জোড়া কখনো ভাঁজ করে লুকানো থাকে। ফুলের ওপর বসে পা ছড়িয়ে বুঝতে পারে স্বাদ কেমন। ওদের জিহ্বাটা আবার পায়েই কি না!
মানুষের মতো দেশ-জাতিভেদে প্রজাপতিরও খাওয়াদাওয়ার রুচিতে বিস্তর ফারাক আছে। তা না হলে কি আর দক্ষিণ আমেরিকার প্রজাপতি মরা মাছ, ইকুয়েডরে মৃত সাপ ও ব্যাঙ এবং ভেনিজুয়েলায় বিষাক্ত টারানটুলার লাশ থেকে রস খেয়ে বাঁচে?
পিউপা অবস্থায় থাকার সময় এরা খুব মৃদুস্বরে চিঁচিঁ আওয়াজ তুলতে পারে। আগে ভাবা হতো এটা তাদের পোকামাকড়কে ভয় পাইয়ে দেওয়ার কৌশল। পরে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এভাবে নাকি পিঁপড়া বন্ধুকে ডাকে তারা। কেউ কেউ এটাকে বলেন শুঁয়ো পোকার গান। এখন থেকে বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানোর সময় খেয়াল রেখো, কে জানে হয়তো শুনতে পাবে 'শুঁয়ো পোকা সংগীত'!
Source: Daily Kalerkantho
No comments:
Post a Comment